বর্তমানে পৃথিবীতে থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক। আমরা অনেকে এই রোগের নাম শুনলেও বা আশেপাশে আক্রান্ত রোগী দেখলে কিংবা নিজে আক্রান্ত হলেও আমরা এই রোগ সম্পর্কে অনেকেই খুব একটা জানিনা। চলুন তাহলে এই সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক
থাইরয়েড কি?
থাইরয়েড হল আমাদের একটি গ্রন্থি যা আমাদের গলার সামনের দিকে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে কিছু প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন আমাদের বিপাক সহ আরো বিভিন্ন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই হরমোন তৈরির জন্য এই গ্রন্থিটির প্রয়োজনীয় পরমাণে আয়োডিনের দরকার হয়। উক্ত হরমোন আমাদের বিপাক ক্রিয়া সহ বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
থাইরয়েড গ্রন্থি
থাইরয়েড গ্রন্থি সাধারণত দুই ধরণের হরমোন নিঃসরণ করে।
ট্রাই-আয়োডোথাইরোনিন(T3)
থাইরক্সিন(T4)
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জন্মের সময় এই গ্রন্থি ঠিকভাবে তৈরি না হলে কিংবা প্রয়োজনমত হরমোন তৈরি করতে না পারলে বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
আমাদের শরীরে যতটুকু হরমোন প্রয়োজন তার চেয়ে কম কিংবা বেশি পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে তখন নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। প্রয়োজনের তুলনায় কম পরিমাণে এই হরমোন তৈরি হলে হাইপোথাইরয়ডিজম হতে পারে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পরিমাণে এই হরমোন উৎপন্ন হলে হাইপারথাইরয়ডিজম হতে পারে। উভয়ই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
এছাড়াও উক্ত গ্রন্থিতে আরো বিভিন্ন রকমের রোগ হতে পারে। সাধারণত বেশি হয় এমন কিছু রোগ নিয়ে আলোচনা করা যাক
- হাইপোথাইরয়ডিজম(Hypothyroidism)
- হাইপারথাইরয়ডিজম(Hyperthyroidism)
- গয়েটার(Goiter)
- নডিউল(Nodule)
- থাইরয়েড ক্যান্সার(Thyroid Cancer)
- গ্রেভস ডিজিজ(Graves' disease)
- হাইপোথাইরয়ডিজম(Hypothyroidism )
থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন উৎপাদন করে তখন হাইপোথাইরয়ডিজম হবার সম্ভাবনা আছে। যদিও অনেক সময় এর চোখে পড়ার মত লক্ষণ দেখা যায়না, যার ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না তারা হাইপোথাইরয়ডিজম এ আক্রান্ত।
তবে হাইপোথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলঃ
- ক্লান্তি কিংবা অবসাদ অনুভব করা
- কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা।
- শুষ্ক ত্বক
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- অল্পতেই শীত শীত লাগবে
- পেশী এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যাথা অনুভূত হবে।
- বিষণ্ণতা থাকবে
মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের সময় অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তক্ষরণ হতে পারে।
পালস রেট কম থাকতে পারে স্বাভাবিক এর তুলনায়।
হাইপারথাইরয়ডিজম:
এক্ষেত্রে হাইপারথাইরয়ডিজম এর উল্টো ঘটনা ঘটে। থাইরয়েড গ্রন্থি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হরমোন উৎপাদন করলে হাইপারথাইরয়ডিজম হবার সম্ভাবনা থাকে।
থাইরয়েড গ্রন্থিকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি নামক এক গ্রন্থি। মস্তিষ্কের এই পিটুইটারি গ্রন্থি কে আবার নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামক অংশ। এই হাইপোথ্যালামাস থাইরয়েড রিলিজিং হরমোন(TRH) নামক এক হরমোন নির্গত করে। এই TRH হরমোন এর কাজ হল পিটুইটারি গ্রন্থি কে থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন(TSH) নামক এক হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠানো। এই TSH হরমোন উক্ত গ্রন্থি কে থাইরয়েড হরমোন নির্গত করার জন্য সংকেত পাঠায়। বোঝা গেল তাহলে এই হরমোন উৎপাদন এর জন্য শুধুমাত্র থাইরয়েড গ্রন্থি দায়ী নয়। হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি গ্রন্থি এবং থাইরয়েড গ্রন্থির মিলিত প্রচেষ্টায় হরমোন নির্গমণ কাজ সম্পন্ন হয়।
এখন উক্ত ৩ টি গ্রন্থির যে কোনো একটি বা একাধিক গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করে ফেলে তখন ফলাফল হিসেবে যতটুকু হরমোন দরকার তার চেয়ে বেশি পরিমাণ হরমোন উৎপন্ন হয়। আর তখনই বাঁধে সমস্যা। যেটা হাইপারথাইরয়ডিজম নামে পরিচিত।
হাইপারথাইরয়ডিজম হলে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখা যায়ঃ
- অতিরিক্ত ঘাম
- গরম সহ্য না করতে পারা
- হজমে সমস্যা
- দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বেড়ে যাওয়া।
- অস্থিরতা অনুভব করা।
- ওজন কমে যাওয়া
- পালস রেট বেড়ে যাওয়া
- ঠিকমত ঘুম না হওয়া
- চুল পাতলা এবং ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া
- ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া
- মহিলাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব অনিয়মত কিংবা খুব অল্প পরিমাণে হওয়া।
বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে। খুব খারাপ অবস্থা হলে এবং হাইপারথাইরয়ডিজম এর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না নেয়া হলে থাইরয়েড স্টর্ম(thyroid storm) হতে পারে। এতে রোগীর রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, জ্বর আসতে পারে এবং হৃদস্পন্দন বন্ধ ও হয়ে যেতে পারে।
হামিও মেডিসিন : হোমিওপ্যাথিতে থাইরয়েডের চিকিৎসায় থাইরয়েডিনাম ছাড়াও আয়োডিন, নেট্রাম মিউর, লাইকোপিডিয়াম, সাইলেসিয়া, ফিডোরিনাম, থুজা, মেডোরিনামসহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের ওপর আসতে পারে তবে কখনোই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না। কারণ চিকিৎসক তার অভিজ্ঞতার আলোকে ওষুধ নির্বাচন করে থাকেন যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওষুধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতির সম্ভবনা প্রবল থাকে।থাইরয়েড এর সমস্যায় লক্ষন ভিত্তিক বেস্ট ৩টি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের বর্ননা নীচে দেওয়া হল।
১Thyroidinum (থাইরয়েডিনাম):~
মূলকথা:
১। দেহ ও মনের খর্বতা।
২। অতিরিক্ত মোটা হতে থাকুক বা ফুলতে থাকা কিংবা অতিরিক্ত রক্তহীনতা ও শীর্ণতা।
৩। চর্মরোগ ও চুল উঠে যাওয়া।
৪। উম্মাদ ভাব এবং অনিদ্রা।
চরিত্রগত লক্ষণ:
১. দেহ ও মনের খর্বতা। উন্মাদ ভাব এবং অনিদ্রা। অঘোরে ঘুম ও অস্থিরতাসহ বিষাদ পর্যায়ক্রমে উপস্থিত, উত্তেজনা প্রবণ, অল্প প্রতিবাদে উত্তেজিত হয়, সামান্য কারণে চটে উঠে। উত্তেজিত উত্তেজনার পরেই মানসিক অবসাদ। হতবুদ্ধি ভাব, রাতে ভয়ের অভিব্যক্তি। অত্যন্ত কোপন স্বভাব, অল্পে অসন্তুষ্ট, সর্বদাই বিষন্ন, সর্বদাই বিরক্ত, অকারণে কাঁদে, উলঙ্গ হয়, আত্মহত্যার ইচ্ছা।
২. অতিরিক্ত মোটা হতে থাকা কিংবা অতিরিক্ত রক্তহীনতা, প্রবল দূর্বলতা ও শীর্ণতা। রোগী সময় সময় সাংঘাতিক রুপে রক্তহীন হয়ে পড়ে ও শরীর কঙ্কালসার হয়।
৩. চর্ম রোগ এবং চুল উঠিয়া যাওয়া।
৪. থাইরয়েড গ্রন্থির দূর্বলতা থেকে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি দ্রব্য খাওয়ার প্রবৃত্তি জন্মে।
৫. অত্যন্ত শীতার্ত ।
৬. মিষ্টি দ্রব্যে আকাঙ্খা।
৭. রক্তাল্পতা, শীর্ণতা, পেশী সংক্রান্ত দূর্বলতা, ঘাম, মাথা ধরা, মুখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্নায়ুবিক কম্পন, ঝিন্ঝিন্ করার অনুভূতি ও পক্ষাঘাত সৃষ্টি করে। হৃৎক্রিয়া ঘাড়ে, চক্ষুগোলক বহির্নির্গত ও প্রসারিত হয়। শ্লৈষ্মিক শোথ ও গলগন্ডসহ জড়বুদ্ধি রোগে ভাল কাজ করে।
৮ . স্ত্রীলোকের ঋতু এক বৎসর যাবৎ বন্ধ থাকলে ও এই ঔষধ সেবনে এক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় ঋতু আবির্ভাব সম্ভব হইয়া থাকে। ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে স্তনে দুগ্ধ ক্ষরণ বেড়ে যায়। ঋতুস্রাব -পরিমানে প্রচুর, দীর্ঘস্থায়ী, অল্প বয়সেই রজ:লোপ।
৯. ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে স্তনে দুগ্ধ ক্ষরণ বেড়ে যায়।
১০. ঠান্ডা পানির পিপাসা।
১১. রাত্রে, গাড়িতে বমি ভাব, ঠান্ডায় -বৃদ্ধি।
১২. ক্ষীণ, অবিরাম নাড়ী। সামনে ঝুকিলে বুক ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়, বুক ধড়ফড়ানির জন্য বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না। দ্রæত নাড়ী (ন্যাজা)। বুকে উদ্বেগ বোধ- যেন বুক সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। সামান্য পরিশ্রমে বুক ধড়ফড়ানি। হৃৎপিন্ডে প্রবল ব্যথা। সামান্য কারণেই হৃৎপিন্ডের প্রবল উত্তেজনা জন্মে। হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া দূর্বল, সেই সাথে আঙ্গুলের অবশতা।
--------------------------------------------------------------
২আয়োডিনাম:
ক্রিয়াস্থান :গ্ল্যান্ড সমূহের উপর, স্ত্রীলোকদের স্তন, ডিম্বাকোষ, শ্লৈম্মিক ঝিল্লি, অন্ত্রর ক্রিয়া প্রকাশ করে।
চরিত্রগত ও ধাতুগত লক্ষণ :
১. অত্যান্ত ক্ষুধা এবং প্রচুর আহার সত্বেও শীর্ণতা। খাওয়ার পর রোগী শান্তি পায়। খাইলে শান্তি পায় না খাইলে অশান্তি শুরু হয়।
২. দেহের শীর্ণতা, রোগী, রোগী এত খায় তবুও শুকাইয়া যায়।
৩. স্থন দুইটি শুকাইয়া ন্যাকড়ার মত হইয়া পড়ে।
৪. থাইরয়েড, স্তন, যকৃত, ডিম্ভাধার, অন্ডকোষ, গ্রীবা, প্রষ্টেট গ্রন্থি বা গলা ফোলা, মুত্রাশয় ফুলিয়া শক্ত হইয়া যায়।
৫. রোগী গরম কাতর তবে সবসময় ঠান্ডা চায়। ঠান্ডা বাতাস, ঠান্ডা পানীয় প্রিয়।
৬. সামান্য কারনে ঠান্ডা বা সর্দি লেগে যায়।
৭. অত্যান্ত গরম পবণতা ও দুর্বলতা।
৮. স্নান করিতে আগ্রহী, অনেক সময় ২/৩ বারও স্নান করে ।
৯. রোগী সামান্য পরিশ্রমেই দুর্বল হইয়া পড়ে।
১০. সিঁডি দিয়া উপরে উঠিতে গেলে মনে হয় দম বন্ধ হইয়া যাইবে।
--------------------------------------------------------------
৩নেট্রাম মিউর:~~~~
সারসংক্ষেপঃ আলস্য, নম্রতা, ইন্দ্রিয়শক্তির মন্হরতা, জৈব তরল পদার্থ নষ্ট হয়ে রক্ত শূন্যতা ও শ্লেষ্মাপ্রধান ধাতু ব্যক্তি। গলার মাঝে প্লাগ থাকার অনুভূতি। প্রাতে, প্রাত ১০টায়, পূর্বাহ্নে, দৈহিক পরিশ্রমে, ময়দা দ্বারা প্রস্তুত খাবারে, ঋতুস্রাবের আগে ও প্রারম্ভে, গরমে, সূর্যোত্তাপে, মানসিক পরিশ্রম ও সান্তনায় বাড়ে। ঠাণ্ডা পানিতে গোসলে, শুয়ে থাকলে, ঘামের পরে, চাপে, দীর্ঘ শ্বাসে, ডানপাশে শয়নে ও কাপড় এঁটে পরলে কমে। ক্রোধ-খিটখিটে, উৎকণ্ঠা,প্রেমাতুর, নির্বাক দুঃখ, বিষণ্নতা, অত্যানুভূতিযুক্ত, ঔদাসীনতা, প্রলাপ, অসন্তুষ্ট, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা, কাঁদে। তেতো ও লবণপ্রিয়তা। প্রকাশ্য স্হানে প্রস্রাব করতে লজ্জাবোধ। পুরনো আশাভঙ্গ হতে রোগোৎপত্তি। দীর্ঘ সময় অবনত হয়ে থাকলে কোমর বা পিঠ ব্যথা করে। ঘামাবস্হায় মাথাব্যথা ছাড়া অন্য সকল লক্ষণের উপশম। শীর্ণতা, স্বপ্নসঞ্চরণ, রক্তাল্পতা ও রক্তস্রাব।
বিশেষ লক্ষণঃ ১) পুরনো আশাভঙ্গ হতে রোগোৎপত্তি। ২) দীর্ঘ সময় অবনত হয়ে থাকলে কোমর বা পিঠ ব্যথা করে।
অনুভূতিঃ ১) জিবে চুল থাকার অনুভূতি। ২) উত্তাপের ঝলকাবোধ: ঘুমের সময়, যেনো গরম পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে এরূপ। ৩) উত্তাপের অনুভূতি : জাগলে, রক্তবহা নালিগুলোতে। টেনে লম্বা করার অনুভূতি।
--------------------------------------------------------------
Compilation: drforhadfbpage
সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পেতে হলে জানতে হবে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ/নির্দেশনা,ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা উচিত নয়।
Post a Comment