মলদ্বারে যেকোনো রোগই হোক না কেন, সাধারণ মানুষ মনে করে পাইলস বা অর্শ বা গেজ। অনেকের ধারণা নেই যে, এর বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা রয়েছে। চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। অনেকে আবার মলদ্বারে মরণব্যাধি ক্যানসার নিয়ে পাইলসের চিকিৎসার জন্য কবিরাজ, হেকিম কিংবা কোনো হাতুড়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সেক্ষেত্রে তারা অপচিকিৎসার মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন এবং বলছেন পাইলস চিকিৎসা করে ভালো হয় না।





তবে এটা সম্পূর্ণ এক ভ্রান্ত ধারণা। পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করে কোনো বিশেষজ্ঞ সার্জন যদি চিকিৎসা করেন তবে এটি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।


আমাদের সমাজে অসংখ্য রোগী আছে যারা মলদ্বারে বিভিন্ন সমস্যায় ভুগে থাকেন। অনেক সময় লজ্জাবশত বলেন না কিংবা অপচিকিৎসার শিকার হন, এমনকি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। কখনও কখনও এমন পর্যায়ে উপস্থিত হন যে তখন আর অপারেশনের বিকল্প কিছু থাকে না। কিন্তু মানুষ যদি সবাই মলদ্বারের রোগ সম্পর্কে সচেতন হন, সঠিক সময়ে মলদ্বারের চিকিৎসায় পারদর্শী বিশেষজ্ঞ সার্জনের দ্বারস্থ হতেন তবে ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে বিনা অপারেশনে এর চিকিৎসা সম্ভব হত।


মলদ্বারে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। যেমন: এনাল ফিসার, পাইলস, রেকটাল পলিপ, রেকটাল ক্যানসার, আইবিএস, পাইলোনিডাল-সাইনাস, এনাল আবসেস, রেকটাল প্রলাপস, এনাল ওয়াট, প্রকটালজিয়া-ফোগাস ইত্যাদি। রোগ অনুসারে এগুলোর চিকিৎসার ধরনও বিভিন্ন।


কারো যদি পাইলস হয়ে থাকে তাহলে চিন্তার কিছু নেই। শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই বিনা অপারেশনে পাইলসের চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে সেটি নির্ভর করে পাইলসের ধরনের ওপর। পাইলস বিভিন্ন রকম হতে পারে। কতগুলো ভেতরে থাকে, যাকে আমরা ইন্টারনাল পাইলস অথবা অভ্যন্তরীণ পাইলস বলে থাকি। আবার কতগুলো পাইলস থাকে বাইরের দিকে, সেটিকে বলা হয় এক্সটারনাল পাইলস বা এক্সটারনাল হেমরয়েড।


কারো যদি পাইলস হয়, তাহলে তার যে উপর্সগুলো দেখা যায় সেগুলো হলো- মলত্যাগের পর রক্ত যাবে এবং রক্ত যাওয়ার সঙ্গে সাধারণত কোনো ব্যথা হয় না। অনেক রোগী বলে থাকেন, মলত্যাগের পর আমি যখন কমোডের দিকে তাকালাম তখন দেখলাম- মুরগি জবাই করলে যেরকম রক্ত যায়, সেরকম রক্ত ছিটিয়ে রয়েছে। কাজেই পাইলস বা হেমোরয়েড যদি প্রথম ধাপে হয়, সে ক্ষেত্রে মলদ্বারে বাড়তি মাংসের মতো কোনো কিছুই থাকে না। শুধু মলত্যাগের পর তাজা রক্ত যায়।


কারো যদি দ্বিতীয় ডিগ্রি হেমোরয়েড হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে মলত্যাগের পর তাজা রক্ত যায়, সাধারণত ব্যথা হয় না এবং মলত্যাগের পর মনে হয় ভেতর থেকে কি যেন বাইরের দিকে বের হয়ে আসে। এবং সেটি এমনিতেই ভেতরে ঢুকে যায়। কারো যদি তৃতীয় ডিগ্রি হেমোরয়েড হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে মলত্যাগের পর বাড়তি মাংসের মতো বের হয়, আগে এমনিতেই ঢুকে যেত এখন চাপ দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হয়। কারো যদি চতুর্থ ডিগ্রি হোমোরয়েড হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আগে মলত্যাগের পর বাড়তি যে মাংসটি বের হতো সেটি এমনিতেই ঢুকে যেত, এখন আর ঢুকছে না এবং ব্যথা হচ্ছে- এ রকম সমস্যা নিয়ে অনেক রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এটিকে আমরা বলে থাকি থ্রববোসড হেমোরয়েড। কাজেই পাইলসের চিকিৎসা তার ধরনের ওপর নির্ভর করে।


কেউ যদি প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের কাছে আসেন, তার যদি প্রথম ডিগ্রি হেমোরয়েড হয়ে থাকে- সেক্ষেত্রে কিন্তু কোনো অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের রোগীকে আমরা ওষুধ দিয়ে থাকি এবং পায়খানা স্বাভাবিক রাখার জন্যে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, পানি পান করতে বলি। কারো যদি কোষ্ঠকাঠিন্য থাকে, তাহলে মল নরম করার জন্য কিছু ওষুধ দিয়ে থাকি। তাতে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী ভালো থাকেন। কারো যদি সেকেন্ড ডিগ্রি হোমোরয়েড হয়ে থাকে, তাদেরও আমরা অপারেশন করি না, চেম্বারের মধ্যেই আধুনিক চিকিৎসা করে থাকি। যেমন ইনজেকশন দিয়ে থাকি, যেটিকে আমরা স্ক্লেরো থেরাপি বলে থাকি। আবার কারো ক্ষেত্রে রিং লাইগেশন করে থাকি। যেটিকে বলা হয় রাবার রিং লাইগেশন। তবে কারো যদি থার্ড ডিগ্রি, ফোর্থ ডিগ্রি হেমোরয়েড হয়ে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে আবার অপারেশনের প্রয়োজন হয়; কিন্তু আজকাল অপারেশন একেবারেই কষ্টদায়ক নয়। আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে লেজারের মাধ্যমে, অথবা স্টেপল হেমোরয়ডোপেক্সি, একপ্রকার যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা অপারেশন করে থাকি। এর মধ্যে বাইরের কোনো কাটাছেঁড়া হয় না, মলদ্বারের ভেতর থেকে একটু বাড়তি মাংসের মতো জিনিস কেটে নিয়ে আসি। রোগীদের সাধারণত মলত্যাগের পর তেমন ড্রেসিংয়ের প্রয়োজন হয় না, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন এবং দুই-তিন দিন পর থেকেই স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে পারেন।


তবে কারও যদি মলদ্বারাটি একদম বাইরে বের হয়ে আসে, তার মধ্যে ইনফেকশন হয়; সেক্ষেত্রে কেটে অপারেশন করতে হয়। সেটিকে বলা হয় ওপেন হেমোরয়েডটমি বা ক্লোজ হোমোরয়েডটমি। কাজেই মলদ্বারে পাইলস হলে সর্বক্ষেত্রে যে অপারেশন লাগবে, সেরকম কিছু না। চিকিৎসক দেখে নির্ণয় করবেন, আসলে পাইলসটি কোন পর্যায়ে আছে, এটির কোন চিকিৎসা লাগবে। কাজেই মলদ্বারে পাইলসজনিত যদি কোনো সমস্যা হয়, প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে কোনো অপারেশনের প্রয়োজন নেই। শুধু ওষুধের মাধ্যমে সেটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।


Post a Comment

Previous Post Next Post