দেহের প্রয়োজনীয় উপাদান কোলেস্টেরল। কিন্তু রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে ধমনির প্রাচীর পুরু হয়ে নানা রোগ বাসা বাঁধে। রক্তে কোলেস্টেরল বা চর্বি নিয়ে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে।  



চিকিৎসকদের মধ্যে বিশেষ করে মেডিসিনে যাঁরা প্র্যাকটিস করেন, তাঁদের অনেকের মধ্যেও কোলেস্টেরল নিয়ে বদ্ধমূল এক কোলেস্টেরল নিয়ে যত ভুল ধারণা ও বাস্তবতা ।

টি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।


ধারণাটি হলো—তাঁরা মনে করেন, যত দিন রক্তে কোলেস্টেরল বেশি পাওয়া যাবে তত দিনই শুধু কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ খেতে হবে। ব্যাপারটি আসলে তা নয়। এটা অবৈজ্ঞানিক ধারণা বা অজ্ঞতা।


যাঁদের রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রয়েছে তাঁরা তো বটেই, বিশেষ করে অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের ডায়াবেটিক রোগীদের (বয়স ৪০) ক্ষেত্রে এ কথা মোটেও প্রযোজ্য নয়। কোলেস্টেরল বেশি হলে তা কমানোর ওষুধ (স্টাটিন) খেয়ে যেতে হবে সারা জীবন। বিষয়টির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো—


প্রথমত : ওষুধ খেয়ে, ইনসুলিন নিয়ে বা অন্য কোনোভাবে হোক, ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক দেখা যেতেই পারে। কিন্তু তাঁদের রক্তনালির গাত্রের কোলেস্টেরল বা হার্টের রক্তনালির কোলেস্টেরল কিন্তু কমে না; বরং বাড়তেই থাকে। তখন ওষুধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণে না আনলে ঝুঁকি বাড়ে।



দ্বিতীয়ত : ডায়াবেটিসের কারণে ডায়াবেটিক রোগীর রক্তনালির গাত্রের আবরণ বা কোষগুলো অস্বাভাবিক বা অ্যাবনরমাল থাকে। তখন কোলেস্টেরলের ওষুধ (স্টাটিন) খেলে তা নরমাল অবস্থায় চলে আসে।

তৃতীয়ত : ডায়াবেটিক রোগীর রক্তনালির গাত্রে ক্রমাগত এক ধরনের নীরব প্রদাহ (সাইলেন্ট ইনফ্লামেশন) চলতে থাকে। স্টাটিন খেলে সেই প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

চতুর্থত : ডায়াবেটিক রোগীর হৃৎস্পন্দনে অস্বাভাবিক গতি হতে পারে। কোলেস্টেরলের ওষুধ খেলে এই অস্বাভাবিক গতির প্রবণতা কম থাকে।


শুধু কি ডায়াবেটিক রোগী?

এই বিভ্রান্তিটা শুধু ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে যে ঘটে তা নয়; বরং কমবেশি সাধারণ রোগী, যাঁদের কোলেস্টেরল বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে। যাঁদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি, তাঁদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শে মাঝেমধ্যে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোলেস্টেরলের ওষুধ স্টাটিন চালিয়ে যাওয়া।

কোলেস্টেরল কমানো ছাড়াও স্টাটিনের অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টা কাজ আছে। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের ওষুধের মধ্যে একমাত্র স্টাটিনই বেশি মৃত্যুঝুঁকি কমায়।


কোলেস্টেরল কী?

শরীর গঠনে অন্যান্য উপাদানের মতো কোলেস্টেরল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কোটি কোটি দেহকোষের প্রাচীর, বহুসংখ্যক হরমোনসহ অসংখ্য শরীরবৃত্তীয় ক্রিয়া-বিক্রিয়ার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো এই কোলেস্টেরল। প্রাণীর মস্তিষ্কের প্রায় পুরোটাই কোলেস্টেরল দিয়ে তৈরি। তাহলে কোলেস্টেরল খারাপ হবে কেন?

বিষয়টি আসলে খারাপ বা ভালোর নয়। প্রতিটি জিনিসেরই একটি মাত্রা থাকে। মাত্রা ছাড়িয়ে গেলেই সমস্যা দেখা দেয়।


পরীক্ষা

কারো রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা জানতে হলে অন্তত ১০ ঘণ্টা খালি পেটে একটি লিপিড প্রফাইল পরীক্ষা করে দেখা দরকার। লিপিড প্রফাইলে টোটাল কোলেস্টেরল, হাই ডেনসিটি লিপোপ্রটিন (এইচডিএল), লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এইচডিএল) এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের বিস্তৃত বিবরণ থাকে। এই চারটি উপাদানের আনুপাতিক উপস্থিতি পরবর্তী চিকিৎসা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেকে শুধু টোটাল কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড পরীক্ষার উপদেশ দেন। তাতে করে এইচডিএল এবং এলডিএলের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে বোঝা সম্ভব হয় না।

সুতরাং সবার উচিত বয়স ৩০ বা তার বেশি হলে অথবা বংশে কেউ যদি হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, তাহলে বছরে অন্তত একবার হলেও লিপিড প্রফাইল পরীক্ষাটি করা।


ভালো বনাম খারাপ কোলেস্টেরল

রক্তনালির দেয়ালে জীবন্ত কোষের অবিরাম ভাঙা-গড়া চলতে থাকে। সুস্থ মানুষের এই ভাঙা-গড়ার মধ্যে একটি পারফেক্ট ব্যালান্স থাকে। কিন্তু যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল আছে, যাঁরা ধূমপান বা তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ করেন, স্থূল শরীর ব্যায়ামহীন কাটান, তাঁদের রক্তনালির জীবন্ত কোষের ভাঙা-গড়ার প্রক্রিয়াটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। কোষের এই ভাঙা-গড়ার প্রক্রিয়ায় এইচডিএল কোলেস্টেরল রক্তনালি রক্ষায় পজিটিভ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য একে ভালো কোলেস্টেরল বলা হয়ে থাকে।

আর এলডিএল কোলেস্টেরল বিশেষ করে পরিবর্তিত অক্সিডাইজড এলডিএল রক্তনালির দেয়ালে এক ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে এই প্রদাহের ফলে রক্তনালির গাত্রে চর্বির দলা গড়ে উঠে রক্তনালিকে সরু করে রক্তের প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে।

সাধারণ মানুষ এটাকে ব্লক বলে থাকেন। কোনো ব্লক যখন রক্তনালির কমপক্ষে ৭০ শতাংশ নালিকা সরু করে দেয়, তখন অল্প পরিশ্রমে বুকে ব্যথা, চাপ, শ্বাসকষ্ট বা ধড়ফড় শুরু হয়ে যায়। চিকিৎসার ভাষায় একে বলে অ্যানজাইনা।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, হার্ট ব্লক বা ব্রেন স্ট্রোক সৃষ্টিতে কোলেস্টেরলের ভূমিকা মূল। যার যত ভালো কোলেস্টেরল বা এইচডিএল বেশি থাকবে এবং মন্দ কোলেস্টেরল বা এলডিএল কম থাকবে, সে তত নিরাপদ থাকবে।


লক্ষ্যমাত্রা

গুড কোলেস্টেরল (এইচডিএল) পুরুষের ক্ষেত্রে ৪০ মিলিগ্রামের ওপরে এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৫০ মিলিগ্রামের ওপরে থাকতে হবে। মন্দ কোলেস্টেরলের (এলডিএল) মাত্রা সুস্থ মানুষের জন্য ১৩০ থেকে ১৬০ মিলিগ্রামের মধ্যে থাকতে হবে। তবে যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে ১০০-এর মধ্যে রাখা নিরাপদ। আর যাঁদের এরই মধ্যে হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে বা ব্রেন স্ট্রোক বা পায়ের রক্তনালিতে ব্লক ধরা পড়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এলডিএলের মাত্রা ৭০ মিলিগ্রামের নিচে রাখা উচিত। ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ২০০ মিলিগ্রামের নিচে রাখলে ভালো।

প্রতিরোধে করণীয় ও খাবারদাবার


প্রতিরোধের উপায়

❏ কোলেস্টেরল মেটাবলিজম ভারসাম্যহীনতার কারণ নির্ণয় ও প্রতিকার করা।

❏ ডায়াবেটিসকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

❏ উচ্চ রক্তচাপের উপযুক্ত চিকিৎসা করা।

❏ ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করতে হবে।

❏ ওজন কমাতে খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।  

❏ যাঁদের ডায়াবেটিস আছে, তাঁদের বয়স ৪০ হলে সারা জীবনের মতো স্টাটিনজাতীয় ওষুধ খেতে হবে।

❏ ডায়াবেটিসের ওষুধ যেমন সারা জীবন খেতে হয়, তেমনি চর্বি কমানোর ওষুধও সারা জীবন খেতে হবে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছাড়া স্টাটিন কখনো বন্ধ করা যাবে না। অনেক সময় দেখা যায়, চর্বির মাত্রা স্বাভাবিক হলে ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি একটি ভুল ধারণা এবং অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। ডায়াবেটিসের ওষুধ বন্ধ করলে রক্তের সুগার যেমন বেড়ে যায়, তেমনি কোলেস্টেরলের ওষুধ বন্ধ করলে তা-ও বেড়ে যায়।


খাবারদাবার

❏ কোলেস্টেরল লেভেল ঠিক রাখতে প্রচুর তাজা শাকসবজি, ফলমূল, উদ্ভিজ প্রোটিন বেশি করে খাওয়া উচিত।

❏ পর্যাপ্ত মাছ, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ খেতে পারলে ভালো।

❏ মাংস খেতে চাইলে সপ্তাহে দুই দিন মুরগির মাংস খাওয়া যেতে পারে। তবে চামড়া, গিলা ও কলিজা—এসব ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাদ দেওয়া উচিত।

❏ সম্ভব হলে দুই বেলা ব্রাউন রুটি এবং দুপুরে একবেলা পরিমিত পরিমাণে (সম্ভব হলে ঢেঁকিছাঁটা চালের) ভাত খাওয়া ভালো।


যা খাওয়া যাবে না

শরীরের মোট চর্বির প্রায় ৮০ শতাংশ তৈরি বা নিয়ন্ত্রণ করে লিভার। বাকি মাত্র ২০ শতাংশ আসে খাদ্য থেকে। তাই চর্বি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য উপাদানের প্রভাব তুলনামূলক কম। তা সত্ত্বেও কিছু খাবার বর্জন করা বা কম খাওয়া উচিত। সেগুলো হলো—

❏ প্রাণিজ লাল মাংস যেমন—গরু, খাসি, ভেড়া, দুম্বা, মহিষ, উট, হাঁস ইত্যাদির মাংস।

❏ ঘি, মাখন।

❏ সরযুক্ত ঘন দুধ।

❏ চিংড়ি মাছ।

❏ পোলাও, বিরিয়ানি, যেকোনো তেলে কড়কড়ে ভাজা ইত্যাদি খাবার।

❏ যেকোনো প্রাণীর দেহের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাওয়া উচিত নয়। তবে দেহের প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল ও পর্যাপ্ত আয়রন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ‘ডি’ জোগান দিতে প্রতিদিন একটি কুসুমসহ ডিম ও পাতলা সরমুক্ত এক কাপ দুধ পান করা স্বাস্থ্যকর।  


লেখক : সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল


Post a Comment

Previous Post Next Post